পশুর জাত বাছাই করণ:-
নিম্নলিখিত জাতের গরু দিয়ে শুরু করলে ভাল ফল পাওয়া যায়:-
১/জার্সি - একটি বয়স্ক ষাড়ের ওজন হয় ৬০০-৭০০ কেজি।
২/শাহিওয়াল - একটি বয়স্ক ষাড়ের গড় ওজন হয় ৫০০- ৫৫০ কেজি।
৩/হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান -একটি বয়স্ক ষাড়ের ওজন হয় ৮০০-৯০০ কেজি।
৪/রেড সিন্ধি - একটি বয়স্ক ষাড়ের ওজন হয় ৪৫০-৫০০ কেজি।
কি দেহের বা আকৃতির পশু খরিদ করবেন:-
পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে পশুর বয়স ২-৩ বছরের মধ্যে হলে সহজে মোটাতাজা করা যায়। বয়স্ক গরু মোটাতাজাকরণের জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়। গরু সাধারণত ষাড় হওয়া ভালো। ষাড় গরুর মাংসের মূল্য এবং চাহিদা বেশি।
পশু খরিদ করার সময় অবশ্যই নিম্নলিখিত বিষয় দেখে খরিদ করতে হবে:- *দেহের আকৃতি ও চেহারা আকর্ষণীয় হবে,চামড়া মসৃন, পাতলা ও হালকা লুজ হবে দেহের গঠন চতূর্ভুজ আকৃতির এবং লম্বাটে হবে।
*মুখ ছোট এবং কপাল চওড়া হবে ,শিং খাট, চোখা, সুঠাম এবং আকর্ষণীয় হবে।
*পেট ঢিলা বা অত্যাধিক নীচের দিকে ঝুলানো হবে না,শরীরের কোথাও কোন ক্ষত থাকা চলবে না।
*চুট উঁচু হবে, গলকম্বল ভরাট হবে এবং বুকের সিনা চওড়া থাকবে,চোখ পরিষ্কার উজ্জ্বল, সজাগ এবং জলজল করবে।
*পা অপেক্ষাকৃত খাট ও মজবুত হবে পায়ের ক্ষুর স্থির, মজবুত সুগঠিত হবে।
*লেজ লম্বা, চেপ্টা এবং মেয়েদের বেণীরমত মোটা থেকে ধীরে ধীরে সরু হয়ে শেষ হবে লেজের মাথায় পর্যাপ্ত চুল থাকবে এবং লেজ উস্কো খুস্কো হওয়া চলবে না।
*শান্ত স্বভাবের পশুকে বাছাই করার চেষ্টা করতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত গরুর ঘর নির্মাণ :-খামার থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন অর্জণ করতে হলে অবশ্যই গরু সুস্থ্ থাকতে হবে,আর গরুকে সুস্থ্ রাখতে হলে গরুর জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক গরুর ঘর ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত ঘর নির্মাণ করার সময় নিম্নোক্ত বিষয় খেয়াল রাখতে হবে:-
* ঘর তৈরির জন্য উঁচু, সমতল ও পানি নিষ্কাশন হয় এবং যাতাওয়াত ব্যবস্থা ভালো এমন জাইগা বেছে নিতে হবে। *ঘর পূর্ব-পশ্চিম লম্বা ও উত্তর-দক্ষিণ দিক আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
* ঘরের চালার উচ্চতা সর্বোনিম্ন ৮ ফিট রাখতে হবে।
* ঘরের মেঝে সামান্য ঢালু রাখতে হবে যাতে গরুর মল মূত্র ঢালু হয়ে ড্রেনে চলে যায়।
*একটি গরুর জন্য ৩ ফিট চওড়া ও ৫ ফিট লম্বা জায়গা রাখতে হবে। জায়গা একটু বেশি রাখলে আরো ভালো।
* গরুর সংখ্যা কম হলে এক সারি বিশিষ্ট ঘর তৈরি করা ভাল। গরুর সংখ্যা বেশি হলে দুই সারি বিশিষ্ট গোয়াল ঘর তৈরি করতে হবে।
* গরুকে খাদ্য ও পানি পান করানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হবে।
* উন্নত জাতের গরু প্রচন্ড গরমে কাহিল হয়ে পড়ে তাই ঘর যাতে শীতল থাকে সে জন্য তাপ শোষক সিলিং দিতে হবে।আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে ফ্যান দিতে হবে।
* শীত কালে গরুর যাতে শীত কম লাগে সে জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে।
* ঘর যাতে সহজে পরিষ্কার করা যায় সেদিকে লক্ষ রাকতে হবে।
* গরুর ঘরের ডিজাইন এমন হতে হবে যাতে গরু সহজে ঘরে ঢুকানো ও বের করা যায়।
গরু মোটাতাজা করণে গরুর খাদ্যে ও পুষ্টি:-
গরু মোটতাজাকরনে দুই ধরনের খাদ্যে তালিকাতে রাখতে হয় :-
১/আঁশ জাতীয় খাদ্যে ২/দানাদার মিশ্রণ খাদ্যে
১/আঁশ জাতীয় খাদ্যে- সবুজ ঘাস, খড়,সাইলেজ। কাঁচাঘাস না পাওয়া গেলে বিকল্প হিসেবে খড় বা সাইলেজ খাওয়াতে হবে, তবে শুধু খড়ে পরিবর্তে ইউ এম এস খাওয়াতে হবে।
ইউ এম এস কি :- ইউরিয়া ও মোলাসেস মিশ্রিত খড় যেভাবে বানাবেন -
১শ’ কজি ইউরিয়া মোলাসেস তৈরির জন্য ৮২ কেজি শুকনো খড় । ১৫ কেজি মোলাসেস বা চিটাগুড়। ৩ কেজি ইউরিয়া সার। ৫০ লিটার পানি।
প্রথমেই পরিমাণমতো খড়, মোলাসেস ও ইউরিয়া মেপে নিতে হবে। এরপর পরিষ্কার পানির সঙ্গে এমনভাবে মেশাতে হবে যেন সম্পূর্ণ দ্রবণ খড়ের সঙ্গে সহজে মিশে যায়। পলিথিন বিছানো বা পাকা মেঝেতে শুকনো খড় সমভাবে বিছিয়ে রেখে তার ওপর ইউরিয়া মোলাসেস দ্রবণ ধীরে ধীরে ঝরনা বা হাত দিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে খড়কে উল্টিয়ে দিতে হবে যাতে সমস্ত খড় দ্রবণ শুষে নিতে পারে। এভাবে স্তরে স্তরে খড় সাজিয়ে তাতে সমঅনুপাতে ইউরিয়া মোলাসেস দ্রবণ মিশিয়ে নিতে হবে।
খেয়াল রাখতে হবে- ইউরিয়ার পরিমাণ যেন কোন ভাবেও বেশি না হয় ইউ এম এস একবার তৈরি করে তিন দিনের বেশি খাওয়ানো ঠিক না খাওয়ানোর পর পরই বেশি পরিমাণ পানি পান করতে দেওয়া উচিত নয়
সাইলেজ কি :-তাজা অবস্থায় ফুল আসার সময় সবুজ ও সতেজ ঘাসকে কেটে টুকরা টুকরা করে কেটে সেগুলো বায়ুরোধী অবস্থায় সংরক্ষণ করাকে সাইলেজ বলে।
যেভাবে বানাবেন -
১/ ঘাস সংগ্রহ ফুল আসার আগে একই পরিপক্বতার ঘাসগুলো কেটে নিতে হবে। সবুজ ঘাসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সাইলেজ হয় ভুট্টার। কারন এই সাইলেজে কান্ড, পাতার সাথে ভুট্টাও থাকে যার ফলে দানাদার খাদ্যের চাহিদাও অনেকটায় পূরণ হয়। এজন্য আধা কাঁচা ভু্ট্টা থাকার সময় সংগ্রহ করা ভালো।
২/ ঘাস শুকিয়ে নেওয়া ঘাসগুলোকে একদিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে যেন ভেজাভাবটা না থাকে। নেপিয়ার ঘাস কাটার পর এতে Dry Matter(DM) থাকে ১৫-২০%। একদিন রোদে শুকানো হলে তা ৩০% এর কাছাকাছি হয়। যা সাইলেজ তৈরির জন্য উপযুক্ত। অন্যদিকে গাছের পাতা কিংবা আগাছা ৪ঘন্টা রোদে শুকিয়ে নিলেই ৩০% DM থাকে। ড্রাই ম্যাটার-৩০% আছে যেভাবে বুঝবেনঃ • কান্ডটি আর্দ্র কিন্তু ভেজা না। • হাতে নিয়ে চাপ দিলে আগের অবস্থানে যাবে না।
৩/ ঘাস ছোট ছোট টুকরো করে নেওয়া ১-৩ ইঞ্চি পরিমাণ করে কেটে নিতে হবে। বেশিপরিমাণে কাটার জন্য বাজারে মেশিন আছে যাকে ‘চপ কাটার’ বলে।
৪/ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করার জন্য চিনি জাতীয় উপাদান যুক্ত করতে হবে। এজন্য লালিগুড় বা মোলাসেস ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া লাল চিনিও ব্যবহার করা যায়। (বিঃদ্রঃ ভুট্টা, জার্মান ঘাসে পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট থাকার কারনে মোলাসেস প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না) প্রতি ১০০ কেজি ঘাসের জন্য ২-৩% বা ২-৩ কেজি মোলাসেস প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মোলাসেসের সাথে একই পরিমাণ পানি যুক্ত করতে হবে।
৫/ এবার সংরক্ষণের জন্য সিলো বা পাত্র ঠিক করতে হবে। এজন্য প্লাস্টিক ব্যাগ বা বস্তা, ড্রাম ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া মাটিতে পুঁতেও সংরক্ষণ করা যায়। ড্রামে সংরক্ষণঃ- ব্যাগটি যেন কোনোরকম ছেঁড়া না হয়। প্রথমে মোলাসেস এবং পানি মিশ্রিত দ্রবণের অর্ধেক পরিমাণ ঘাসে প্রয়োগ করতে হবে। তারপর সেই ঘাস ব্যাগে কয়েকধাপে ভরতে হবে। এক ধাপ ভরার পর ভালোভাবে চাপ দিতে হবে যেন ঘাসগুলোর মাঝে ফাঁকা না থাকে, ফাঁকা থাকলে সেখানে বাতাস থেকে যাবে, যার ফলে সাইলেজ ভালো না হওয়ার ধরুন বেশিদিন ঠিক থাকবে না। • তারপর মোলাসেস মিশ্রিত পানি আবার খানিকটা প্রয়োগ করতে হবে।এভাবে কয়েকধাপে ব্যাগ কিংবা ড্রামে ভালোভাবে ভরে শক্তভাবে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে যেন বাতাস প্রবেশ না করতে হবে।
মাটিতে পুঁতে সংরক্ষণঃ- এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণের জন্য উঁচু স্থান নির্বাচন করতে হবে। • প্রয়োজনীয় পরিমাণ গর্ত করে পলিথিন দিয়ে দিতে হবে। • কয়েকধাপে সমপরিমাণে মোলাসেস এবং পানি মিশ্রিত ঘাস বিছিয়ে দিয়ে আবার মোলাসেস মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করতে হবে। • পা দিয়ে ভালোভাবে চাপ দিয়ে কম্পেক্ট করতে হবে। তারপর উপরে আবার পলিথিন দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাটি চাপা দিতে হবে।উক্ত প্রক্রিয়াটি ১-২ দিনের মাঝে শেষ করতে হবে।
২/দানাদার খাদ্য দানাদার খাদ্য কি:-যেসব খাদ্যে আয়তনের তুলনায় খাদ্যমান অপেক্ষাকৃত বেশি এবং সহজপাচ্য তাকে দানাদার খাদ্য বলে।দানাদার গোখাদ্যগুলো হলো চালের কুঁড়া গমের ভুসি, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকার খৈল, কলাই, ছোলা, খেসারি, সয়াবিন ও শুকনো মাছের গুঁড়া ইত্যাদি।
১০০ কেজি দানাদার খাদ্যে মিশ্রন তালিকা :-
গম ভাঙা/গমের ভূসি– ৪০ কেজি চালের কুঁড়া– ২৩.৫ কেজি খেসারি বা যেকোনো ডালের ভূসি– ১৫ কেজি তিলের খৈল/সরিষার খৈল– ২০ কেজি লবণ– ১.৫ কেজি। মাপ অনুযায়ী সব কয়টি উপকরন এক সাথে ভালভাবে মিশ্রন করলে তৈরি হবে ১০০ কেজি দানাদার খাদ্য।
ওজন অনুযায়ী গরুর খাদ্য তালিকা
১০০ কেজির কম ওজনের গরু -ইউ এম এস বা শুধু খড় ২ কেজি। দানাদার খাদ্য ২.৫-৩ কেজি। কাচা ঘাস ৪-৫ কেজি।
১০০-১৫০ কেজি ওজনের গরু -ইউ এম এস বা শুধু খড় ৩ কেজি। দানাদার খাদ্য ৩-৩.৫ কেজি। কাচা ঘাস ৭-৮ কেজি।
১৫০-২০০ কেজি এবং এর বেশি ওজনের গরু -ইউ এম এস বা শুধু খড় ৪ কেজি। দানাদার খাদ্য ৪-৪.৫ কেজি। কাচা ঘাস ৮-১২ কেজি।
পশু ক্রয় করার পর পরই যে চিকিৎসা করতে হবে
* পশু ক্রয় করার পর তার গোবর পরীক্ষা করান,গোবর পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে কৃমির ওষুধ দেন। *পশু ক্রয় করার পর উকুন, আঠাল এর মতো অন্য পরজীবীগুলি গরুর গা থেকে ছাড়ানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করুন।
* পশু ক্রয় করার পর ভেটেরিনারি ডাক্তারের সাথে আলাপ করে ক্ষুরা, তড়কা এবং গলাফুলা রোগের টিকা দিন। গরু মোটাতাজাকরণে সফল হথে হলে গরুর জীবাণু ঘটিত মারাত্বক রোগ থেকে গরুকে রক্ষা করতে হবে,আর এ জন্য টিকা প্রদানের কোন বিকল্প নেই। নিম্নে কিছু রোগের নাম ও টিকার নাম এবং প্রয়োগের বিষয়ে বলা হল।
রোগের নাম ও টিকা
রোগের নাম-ক্ষুরারোগ
টিকার নাম-লিভ্যালেন্ট এফ.এম.ডি.টিকা
প্রয়োগের পরিমাণ-৬ এম.এল প্রতি প্রাপ্ত বয়স্ক প্রাণী; ৩ মি.লি./প্রতি অপ্রাপ্ত বয়স্ক; প্রথমবার টিকা দেয়ার ২-৪ সপ্তাহ পরে বোস্টার টিকা প্রদান
প্রয়োগের স্থান-চামড়ার নীচে প্রয়োগের সময়-বোস্টার টিকা দেয়ার পর ৪ মাস পর্যন্ত
রোগের নাম- বাদলা
টিকার নাম- বি. কিউ টিকা
প্রয়োগের পরিমাণ- ৫মি.লি./প্রাপ্ত বয়স্ক;২.৫ মি.লি./অপ্রাপ্ত বয়স্ক
প্রয়োগের স্থান-চামড়ার নীচে প্রয়োগের সময়- ৪ মাস
রোগের নাম- তড়কা
টিকার নাম- তড়কা স্পোর টিকা
প্রয়োগের পরিমাণ- ১ মি.লি./প্রাপ্ত বয়স্ক; ০.৫ মি.লি./অপ্রাপ্ত বয়স্ক
প্রয়োগের স্থান-চামড়ার নীচে প্রয়োগের সময়- ১ বৎসর
Apr 10 2022